তরঙ্গের প্রকারভেদ

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - পদার্থবিদ্যা - পদার্থবিজ্ঞান – ১ম পত্র | NCTB BOOK

মাধ্যমের কণাগুলো সরল দোল গতিতে কম্পিত হলে যে তরঙ্গের সৃষ্টি হয় তাকে সরল দোল তরঙ্গ (Simple harmonic wave) বা সাইন তরঙ্গ (Sine wave) বলে। সরল দোল তরঙ্গ আবার দুই প্রকারের। যথা—

(১) আড় তরঙ্গ বা অনুপ্রস্থ তরঙ্গ (Transverse waves) এবং 

(২) লম্বিক তরঙ্গ বা অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ (Longitudinal waves)। 

(১) আড় তরঙ্গ বা অনুপ্রস্থ তরঙ্গ : মাধ্যমের কণাগুলো তরঙ্গ গতির অভিমুখের সমকোণে কম্পিত হতে থাকলে সেই তরঙ্গকে আড় তরঙ্গ বা অনুপ্রস্থ তরঙ্গ বলে।

ব্যাখ্যা : চিত্র ১৭.১-এ একটি অনুপ্রস্থ তরঙ্গ দেখান হয়েছে। তরঙ্গের উপর ছোট ছোট তাঁর চিহ্ন দ্বারা কণার কম্পনের অভিমুখ দেখান হয়েছে। তরঙ্গের উপরের দিকে A ও E বিন্দুতে কণার সর্বোচ্চ সরণ ঘটেছে। তরঙ্গের এই বিন্দুগুলোকে তরঙ্গ শীর্ষ বা তরঙ্গ চূড়া (crest) বলে। আবার নিচের দিকে C বিন্দুতে সর্বোচ্চ সরণ ঘটেছে। একে তরঙ্গ পাদ বা তরঙ্গ খাঁজ (Trough) বলে।

চিত্র : ১৭.১

এক্ষেত্রে কণার স্পন্দনের অভিমুখ তরঙ্গ প্রবাহের অভিমুখের সমকোণে ঘটেছে। অতএব এটা আড় তরঙ্গ।

উদাহরণ:

 (১) পুকুরের পানিতে ঢিল ছুঁড়লে দেখা যায় যে পানির কণাগুলো উপরে-নিচে দুলতে থাকে এবং এই আন্দোলন কিনারার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সৃষ্ট এরূপ আন্দোলনই আড় তরঙ্গ বা অনুপ্রস্থ তরঙ্গ।

 (২) একটি তার টান করে বেঁধে এর দৈর্ঘ্যের সমকোণে টেনে ছেড়ে দিলে তারে একটি তরঙ্গের সৃষ্টি হবে [চিত্র ১৭.২ ]। লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, তারটি এর দৈর্ঘ্যের সাথে সমকোণে আন্দোলিত হচ্ছে। এই আন্দোলন তারের দৈর্ঘ্য বরাবর প্রবাহিত হচ্ছে। সুতরাং টানা তারের এরূপ কম্পন হতে স্পষ্ট যে, এই তরঙ্গ আড় তরঙ্গ।

চিত্র : ১৭.২

আড় তরঙ্গ প্রদর্শন (Demonstration of Transverse wave ) : 

পরীক্ষায় সমান দৈর্ঘ্যের কতকগুলো দণ্ড নেয়া হয় যাদের প্রত্যেকের এক মাথায় একটি করে বল এবং অপর মাথায় একটি করে চাকা যুক্ত আছে [ চিত্র ১৭.৩]। চাকাগুলো একটি হাতলযুক্ত ঘূর্ণনক্ষম দণ্ডের সাথে এমনভাবে লাগানো আছে যে চাকাগুলো কম-বেশি উৎকেন্দ্রিক (eccentric) অবস্থায় থাকে অর্থাৎ দণ্ডগুলো এক এক চাকার এক এক স্থান দিয়ে পরানো থাকে এবং দণ্ডগুলো খাড়াভাবে অবস্থান করে। হাতল ঘুরালে চাকাগুলোও ঘুরতে থাকে এবং দণ্ডগুলো উঠা-নামা করে। চাকাগুলো কম-বেশি উৎকেন্দ্রিক হওয়ায় বিভিন্ন দণ্ডের উপরের প্রান্তের বলগুলো একসঙ্গে উপরে উঠে না বা নিচে নামে না— পর্যায়ক্রমে উঠা-নামা করে। ভালভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে যে বলগুলো যে দিকে উঠা-নামা করে তার সমকোণে তরঙ্গ প্রবাহিত হচ্ছে। সুতরাং এস্থলে উদ্ভূত তরঙ্গ আড় তরঙ্গ।

চিত্র :১৭.৩

 

Content added || updated By
Please, contribute to add content into আড় তরঙ্গ.
Content

(২) লম্বিক তরঙ্গ বা অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ : মাধ্যমের কণাগুলো তরঙ্গের গতির অভিমুখের সমান্তরালে কম্পিত হতে থাকলে, সেই তরঙ্গকে লম্বিক বা অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ বলে। 

ব্যাখ্যা : 

চিত্র ১৭.৪-এ অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ প্রবাহ দেখান হয়েছে। মাধ্যমের বিভিন্ন স্তরের সাম্যাবস্থান কতগুলো সমান দূরত্বের রেখা দ্বারা নির্দেশ করা হয়েছে [চিত্র ১৭.৪ (ক)]।

চিত্র : ১৭.৪

মাধ্যমের ভেতর দিয়ে লম্বিক তরঙ্গ প্রবাহিত হতে থাকলে যে কোন সময়ে স্তরগুলোর অবস্থান কিরূপ হবে তা ১৭.৪ (খ) চিত্রে দেখান হয়েছে। অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গের ক্ষেত্রে মাধ্যমের কণাগুলো সাম্যাবস্থানের উভয় পার্শ্বে তরঙ্গের গতিপথের সমান্তরালে কম্পিত হয়, ফলে তরঙ্গশীর্ষ বা তরঙ্গপাদ সৃষ্টি হয় না। এক্ষেত্রে কম্পনের সময় কিছু কিছু স্থানে কণাগুলো কাছাকাছি চলে আসে আবার কোথাও দূরে সরে যায়। কণাগুলো কাছাকাছি আসায় মাধ্যমের সংকোচন বা ঘনীভবন (compression or condensation) হয় এবং কণাগুলো সরে গেলে মাধ্যমের প্রসারণ (rarefaction) হয়। চিত্রে রেখাগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব কম দ্বারা সংকোচন এবং রেখাগুলোর দূরত্ব বৃদ্ধি দ্বারা সম্প্রসারণ বুঝান হয়েছে। সংকোচনের স্থানগুলোতে মাধ্যমের ঘনত্ব ও চাপ বেড়ে যায় এবং প্রসারণের স্থানগুলোতে মাধ্যমের ঘনত্ব ও চাপ কমে যায়। এভাবে মাধ্যমের কণাগুলোর সংকোচন ও প্রসারণের মধ্য দিয়ে অনুদৈর্ঘ্য ও লম্বিক তরঙ্গ সঞ্চালিত হয়। পাশাপাশি একটি সংকোচন ও একটি প্রসারণ নিয়ে একটি তরঙ্গদৈর্ঘ্য গঠিত হয়।

উদাহরণ :

(১) কথা বলার সময় আমরা জিহ্বার সাহায্যে মুখের মধ্যকার বায়ু কণাতে কম্পন সৃষ্টি করি। বায়ুকণাগুলোর কম্পনের দিক শব্দ তরঙ্গের গতির অভিমুখে সংঘটিত হয়। অতএব শব্দ লম্বিক তরঙ্গ। বক্তা বা গায়কের মুখ হতে শব্দ বায়ু মাধ্যমে সঙ্কোচন ও প্রসারণ সৃষ্টি করে লম্বিক তরঙ্গের আকারে শ্রোতার কানে পৌঁছায়। [ চিত্র ১৭.৪ ]।

(২) একটি স্প্রিং খাড়াভাবে ঝুলিয়ে দিয়ে এর নিচের প্রান্ত খানিকটা নিচের দিকে টেনে ছেড়ে দিলে দেখা যাবে যে স্প্রিং-এর কুণ্ডলী পর্যায়ক্রমে সংকুচিত ও প্রসারিত হতে থাকে । চিত্র ১৭.৫ ] এবং এই স্পন্দন তারের দৈর্ঘ্য বরাবর প্রবাহিত হয় । অর্থাৎ, কুণ্ডলীগুলো সরল দোলন গতিতে তরঙ্গের গতির সমান্তরালে আন্দোলিত হচ্ছে। সুতরাং স্প্রিং-এ সৃষ্ট এই তরঙ্গ লম্বিক তরঙ্গ।

চিত্র : ১৭.৫

লম্বিক বা অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ প্রদর্শন (Demonstration of longitudinal wave) : 

পরীক্ষায় একটি সরু তারের স্প্রিং নিয়ে এর প্রত্যেক কুণ্ডলীকে দুটি অনুভূমিক দণ্ড CD ও CD' হতে V আকারে সিল্ক সুতা দ্বারা এমনভাবে ঝুলানো হয় যে, তারটি অনুভূমিক থাকে | চিত্র ১৭.৬]।

চিত্র :১৭.৬

  এই স্প্রিং-এর এক প্রান্ত ধরে হঠাৎ অনুভূমিকভাবে ধাক্কা দিলে দেখা যাবে যে, তারের কুণ্ডলীগুলো পর্যায়ক্রমে সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হচ্ছে এবং এই স্পন্দন ক্রমে ক্রমে তার বরাবর এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ কুণ্ডলীগুলো তরঙ্গ প্রবাহের দিকেই সরল দোল গতিতে আন্দোলিত হচ্ছে। সুতরাং উদ্ভূত তরঙ্গই লম্বিক তরঙ্গ।

১৭.৪ আড় তরঙ্গ ও লম্বিক তরঙ্গের মধ্যে পার্থক্য 

Distinction between transverse and longitudinal waves 

আড় তরঙ্গ ও লম্বিক তরঙ্গের মধ্যে নিম্নলিখিত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

আড় তরঙ্গলম্বিক তরঙ্গ
১। যে তরঙ্গের ক্ষেত্রে জড় মাধ্যমের কণাগুলির কম্পনের দিক তরঙ্গ প্রবাহের দিকের সমকোণী হয়,তাকে আড় তরঙ্গ বলে।১। যে তরঙ্গের ক্ষেত্রে জড় মাধ্যমের কণাগুলির কম্পনের দিক তরঙ্গ প্রবাহের দিকের সমান্তরাল হয় তাকে লম্বিক তরঙ্গ বলে।
২। তরঙ্গ প্রবাহে মাধ্যমে তরঙ্গ শীর্ষ এবং তরঙ্গ পাদ সৃষ্টি হয়।২। তরঙ্গ প্রবাহে মাধ্যমে সংকোচন ও প্রসারণ সৃষ্টি হয়।
৩। পর পর দুটি তরঙ্গ শীর্ষ বা পর পর দুটি তরঙ্গ পাদের মধ্যবর্তী দূরত্বকে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বলে।৩। পর পর দুটি সংকোচন বা পর পর দুটি প্রসারণের মধ্যবর্তী দূরত্বকে বা একটি প্রসারণ ও একটি সংকোচনের মিলিত দৈর্ঘ্যকে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বলে।
৪। মাধ্যমে এর সমবর্তন বা পোলারণ ঘটে।৪। মাধ্যমে এর সেমবর্তন বা পোলারণ ঘটে না
৫। অনম্যতার বা আকৃতির স্থিতিস্থাপক ধর্মসম্পন্ন মাধ্যমে (কঠিন) এই তরঙ্গ উৎপন্ন হয়। প্রবাহীতে পৃষ্ঠ টানের দরুন আড় তরঙ্গের সৃষ্টি হয়।৫। আয়তনের সিতিস্থাপক এইসম্পন্ন মধ্য (কঠিন, তরল ও গ্যাস।) এই তরঙ্গ উৎপন্ন হয়।

 

Content added || updated By

আরও দেখুন...

Promotion